প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অসামান্য উদ্ভাবন ‘কমিউনিটি ক্লিনিক’কে ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ। কিভাবে গণমুখী এ স্বাস্থ্যসেবা শুরু হয়েছিল, তা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি জানান, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পর স্বাস্থ্যসেবা জনগণের দোড়গোড়ায় নিয়ে যাওয়ার যে কাজ শুরু করেছিলেন, সেই ভাবনা থেকে কমিউনিটি ক্লিনিক এসেছে। শুরুতে অল্প পরিসরে শুরু করলেও কমিউনিটি ক্লিনিক এখন তৃণমূল মানুষের কাছে আস্থার নাম।
কমিউনিটি ক্লিনিক জাতিসংঘের স্বীকৃতি পাওয়ায় বৃহস্পতিবার (১৮ মে) প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানায় মন্ত্রিপরিষদ।
কমিউনিটি ক্লিনিকের শুরুর ইতিহাস জানাতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতির পিতা স্বাধীনতা এনেছিলেনই মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার সুযোগ দিয়ে উন্নত জীবন দেওয়ার লক্ষ্যে। দেশ স্বাধীন করে এবং স্বাধীনতার পর সাড়ে তিন বছরের কম সময়ে দেশকে ভালো এক জায়গায় নিয়ে আসেন। তিনি তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রত্যেক ইউনিয়নে একটি ১০ বেডের হাসপাতাল করে দিয়েছিলেন। পরিবার পরিকল্পনা ব্যবস্থা এবং মাতৃসনদ সেবা তিনি শুরু করেছিলেন। দুর্ভাগ্য যে, পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে সেগুলো কার্যকর হয়নি।’
দীর্ঘ নির্বাসন শেষে দেশে ফিরে এসে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দেখে তাদের জন্য করণীয় নিয়ে ভাবেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘মানুষের ছিন্ন বস্ত্র দেখেছি। অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকত। সেভাবে তারা চিকিৎসা পেত না। ওই সময়ে চিন্তাটা ছিল যে, সরকারে গেলে কী কী করব। ১৯৯৬ সালে যখন সরকার গঠন করলাম, তখন ইউনিয়ন স্বাস্থ্য সেবা গড়ে তোলার একটি চিন্তা করে…. আমার আজকে মনে পড়ছে তখনকার স্বাস্থ্য সচিব মোহাম্মদ আলীর কথা… আমরা বসে বসে লিখেছিলাম, কী করা যায়। হিসেবটা করেছিলাম এভাবে— প্রত্যেকটা জনগোষ্ঠী আমাদের নদী-নালা, খাল-বিলের দেশ… কমবেশি প্রতি ৬ হাজার জনগোষ্ঠীর জন্য একটি প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র গড়ে তুলে যদি মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবাটা দিতে পারি।’
চিকিৎসা পেতে মানুষের যাতে দুর্ভোগ না হয়, সেজন্য কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে উপজেলা-জেলা হাসপাতাল, সেখান থেকে ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালের সঙ্গে একটা চেইন গড়ে তোলার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে দুটি ওয়ার্ড আমরা ঠিক করে দিলাম। একটি ছেলেদের জন্য, একটি মেয়েদের জন্য। কেউ কেউ চিকিৎসার জন্য ঢাকায় এসে যে ডাক্তারের কাছে রেফার করা হতো, সেই ডাক্তারের জন্য তাকে হাসপাতালের বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াতে হতো। ওই ডাক্তারের সঙ্গে যখন দেখা হতো, সে হাসপাতালে ভর্তি হতে পারবে। সেই ব্যবস্থাটাও পরিবর্তন করলাম যে, ১০ টাকা দিয়ে টিকিট নিয়ে সাথে সাথে ওয়ার্ডে ভর্তি হবে আগে। ওখানে ভর্তি হবে, সেখান থেকে বিশেষায়িত ডাক্তার তাকে নিয়ে যাবে।’
মেয়েদের চিকিৎসাসেবায় সরকারের গুরুত্ব দেওয়ার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মেয়েদের জন্য গুরুত্ব ছিল যে, মেয়েরা অসুস্থ হলে স্বামী বা দেওর বা ভাসুর বা শশুর বা বাব-মা কেউ নিয়ে গেলেই চিকিৎসাসেবা পেতো। তাছাড়া চিকিৎসাসেবা নেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। বিশেষ করে, মাতৃত্বকালীন সময়ে আরও কঠিন অবস্থা ছিল। এসব বিষয় ভেবে আমি লিখে মোহাম্মদ আলী সাহবেকে বললাম, আমার এমন একটি চিন্তা আছে। হুট করে তো করা যাবে না, আপনি একটু দেখেন, এটা বাস্তবায়ন করতে গেলে কী কী করা লাগবে। তিনি ওটা নিয়ে বিচার- বিশ্লেষণ করে বললেন, এটা করা যাবে। এটা করা সম্ভব। আমি বললাম, তাহলে একটা প্রকল্প নিয়ে নেন।’
তিনি বলেন, আমাদের অনেকেই এই ব্যাপারে ভালো সহযোগিতা করল এবং সীমিত আকারে শুরু করেছিলাম। আমরা প্রায় ১১ হাজার ঘর করেছিলাম, তার মধ্যে চার হাজার স্বাস্থ্যকেন্দ্র আমরা চালু করে দিলাম। এরপর এক বছর পর একটা সার্ভে করলাম যে, এটা তো করা হলো, কিন্তু রেজাল্টটা কী আসে। মানুষের কতটুকু উপকার হলো? এর মধ্যে কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করল যে, কী হচ্ছে? বিশেষ করে, বিশ্বব্যাংক এগিয়ে আসলো যে, কিভাবে কী হচ্ছে।
বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এসে কমিউনিটি ক্লিনিক বন্ধ করে দেওয়ায় নিজের কষ্টের কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেস, ‘আমাদের তো পাঁচ বছর সময় শেষ। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এসে এটা বন্ধ করে দিলো। এটা বন্ধ করার জন্য খালেদা জিয়ার যুক্তি হলো, কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে মানুষ যদি স্বাস্থ্যসেবা নেয়, তাহলে সবাই নৌকায় ভোট দেবে। তাদেরকে আর ভোট দেবে না। এজন্য বন্ধ করল। আমার খুব কষ্ট লাগল।’
জনগণের ভোটে আবারও ক্ষমতায় এসে কমিউনিটি ক্লিনিক ট্রাস্টের আওতায় নিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘পরবর্তীতে আমি যখন ক্ষমতায় এলাম, তখন আমি চিন্তা করলাম, এটা আর সরকারিভাবে রাখব না। তখন কমিউনিটি ক্লিনিক একটা ট্রাস্টের মাধ্যমে খুললাম। আমার চিন্তা ছিল, ট্রাস্টের মাধ্যমে খুললে এটা আর চট করে বন্ধ করতে পারবে না। এখন সেটায় সরকারি অনুদান আমরা ট্রাস্টের মাধ্যমে দিয়ে দিচ্ছি। যার ওখানে হেলথ প্রোভাইডার থাকবে। পরিবার-পরিকল্পনা বা অন্যান্য কিছু লোক এসে ডিউটি করবে। আর জায়গাটা দেবে স্থানীয় লোক। স্থানীয় লোকজনের দিয়ে কমিটিটা হবে, যেন তাদের একটা অধিকার থাকে। এতে সেটা উন্নত করা বা রক্ষণাবেক্ষণ করা বা যা করা লাগে তারা সেটা করতে পারবে। আর একটা জায়গা ঘিরে কিন্তু অনেক লোকের কর্মসংস্থান হবে। হেলথ প্রোভাইডার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মেয়েদের নিয়ে আমরা ট্রেনিং করাই। এতে বহু মেয়ের কর্মসংস্থান হলো। অনেক ওষুধ কোম্পানি বিনা পয়সায় সেখানে ওষুধ দেওয়া শুরু করল।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি জানতাম না যে, জাতিসংঘে প্রস্তাবটা দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবটা পাস হওয়ার পর আমি জানলাম। বোধহয় ৭০টা দেশ ছিল কো-স্পন্সর। বাংলাদেশের পক্ষে ৭০টা দেশ কো-স্পন্সর হয়ে সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করা হয়েছে, এটা বড় পাওয়া। এতে শুধু স্বাস্থ্যসেবাটাই নিশ্চিত হয়নি, আমরা মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার কমাতে পেরেছি। মাতৃত্বকালীন সেবা তারা পাচ্ছে। সব কিন্তু কম্পিউটারে রেকর্ড থাকে।’
যেসব দেশ কো-স্পন্সর হয়েছে সেসব দেশসহ জাতিসংঘের অন্যান্য দেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে ধন্যবাদ জানানোর কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, এই প্রকল্প কিভাবে করলাম, আমাদের এই অভিজ্ঞতা আমরা সব দেশের সঙ্গে শেয়ার করব।
দেশবাসীকে ধন্যবাদ জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ধন্যবাদ দেশবাসীকে। যদি বারবার ভোট না দিতো, তাহলে আমরা ক্ষমতায় আসতে পারতাম না। মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া আদায় করি যে, এত গুলি-বোমার মুখোমুখি হয়েও আমি বেঁচে আছি এবং দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে পারছি।’