আন্তর্জাতিক ফুটবলের রাজপাটে নতুন করে যেন ভাষাগত এক বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছে ক্লাব বিশ্বকাপ। এই টুর্নামেন্টের মূল ভাষা হয়ে উঠেছে স্প্যানিশ। আর সেই বিপ্লবের মুখচ্ছবি যেন স্বয়ং লিওনেল মেসি—যার নামে সদ্য বাজারে আসা এনার্জি ড্রিঙ্ক ‘মাস বাই মেসি’ উন্মোচনের মুহূর্তটি হয়ে উঠেছে প্রতীকি।
মায়ামির চেজ স্টেডিয়ামে চোখ ধাঁধানো আয়োজনে আর্জেন্টিনার কিংবদন্তি হাভিয়ের জানেত্তি যখন ‘মাস’-এর বোতলের লেবেল পড়ে শুনাচ্ছিলেন, তখন উপস্থিত সবাই যেন মুহূর্তেই বুঝে গেল—এটা কেবল কোনো পানীয়র উদ্বোধন নয়, বরং দক্ষিণ আমেরিকার এক সাংস্কৃতিক দখলযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা।
‘মাস’ শব্দের অর্থই তো ‘আরো’। আরো শক্তি, আরো গতি, আরো সম্ভাবনার ইঙ্গিত। যেই টুর্নামেন্টে মেসির পায়ের জাদু ফুটে ওঠে ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধে, সেখানেই যেন তার পানীয়র প্রতিশ্রুতি বাস্তব হয়ে ওঠে। মজার ব্যাপার, ‘মাস’ শব্দটি কেবল এই ড্রিঙ্ক বা স্প্যানিশ ভাষা বোঝাতেই নয়, বরং এটি ইন্টার মায়ামির মালিক জর্জ ও হোসে মাস ভাইদের নামও। এই একটি শব্দেই যেন ধরা পড়ে ক্লাব বিশ্বকাপের বর্তমান রূপ—জাঁকজমক, সম্প্রসারণ আর এক অপ্রতিরোধ্য লাতিন ছোঁয়া।
ক্লাব বিশ্বকাপের প্রথম রাতেই যে বিষয়টি চোখে পড়ে, তা হলো লাতিন আমেরিকার আধিপত্য। গ্যালারির ৭০ শতাংশের বেশি দর্শক ছিলেন মেসির জার্সি গায়ে দিয়ে আসা আমেরিকান সমর্থক, যেন হ্যালোউইনের রাতেও এত উৎসাহ দেখা যায় না। প্রতিটি প্রচার, প্রতিটি গান, এমনকি ফিফা প্রেসিডেন্ট জিয়ান্নি ইনফান্তিনোর ভাষণেও ছিল স্প্যানিশের আধিপত্য।
এ যেন সত্যিকারের ‘হিস্পানো-লাতিন-ইবেরিয়ান’ টুর্নামেন্ট। শুধুই কি ভৌগোলিক কারণে? মোটেও না। এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন ৩০০ জনের বেশি দক্ষিণ আমেরিকান ফুটবলার, যার মধ্যে ১০৫ জনই আর্জেন্টিনার। এদের মধ্যে ৪৭ জন আর্জেন্টিনার বাইরের ক্লাবে খেলছেন। স্পষ্টতই ফুটবল বিশ্বের এক নম্বর রপ্তানি শক্তি এখন আর্জেন্টিনা।
এই আধিপত্য শুধু মাঠে নয়, ডাগআউটেও। ম্যানচেস্টার সিটির জন স্টোনস কিংবা এরলিং হালান্ড স্প্যানিশ শেখেন খেলায় মানিয়ে নিতে, ক্যালভিন ফিলিপস মানিয়ে নিতে পারেননি বলেই পিছিয়ে পড়েন। এমনকি মেসি একবার মন্তব্য করেছিলেন—কিলিয়ান এমবাপে পিএসজিতে মানিয়ে নিতে পারবেন কারণ ‘সে চমৎকার স্প্যানিশ বলতে পারে।’
ফিফার নতুন সদরদপ্তর এখন ফ্লোরিডায়, একটি অঞ্চল যেখানে স্প্যানিশ ভাষা শুধু সাংস্কৃতিক নয়, রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নিকারাগুয়া, ভেনেজুয়েলা, কিউবা, মেক্সিকো থেকে আগত লাতিন অভিবাসীদের জীবন ও সংগ্রামের প্রতীক এখন ফুটবলের ভাষাও—স্প্যানিশ।
বিশ্ব ফুটবলের নতুন ভাষাগত এই মোড়লত্বের এক প্রতীক মেসি। ক্লাব বিশ্বকাপে খেলা, ড্রিঙ্ক লঞ্চ, স্টেডিয়ামে দেয়ালজুড়ে বিশাল মুর্যাল—সবখানেই তার উপস্থিতি যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, স্প্যানিশই এখন ফুটবলের সার্বজনীন ভাষা।অবশ্য ইউরোপীয় ক্লাবরাই শেষ পর্যন্ত শিরোপা ও আর্থিক সুবিধা নিয়ে বাড়ি ফিরবে। তবে ফিফার ব্যাখ্যা অনুযায়ী, এই টুর্নামেন্ট বিশ্ব ফুটবলে সম্পদ বণ্টনের নতুন একটা সুযোগও এনে দিতে পারে। বহুদিন ধরে ইউরোপের উপনিবেশ হয়ে থাকা দক্ষিণ আমেরিকা এবার যেন বলছে, “নো মাস”—আর না। এবার নিজের জন্যও কিছু রেখে দেওয়ার পালা।
এই টুর্নামেন্ট তাই শুধু ফুটবল নয়, ভাষা, সংস্কৃতি, শ্রেণি ও ভূরাজনীতির এক অনন্য মঞ্চ। যেখানে মেসির পানীয় কেবল একবার চুমুক দেওয়ার মতো নয়, বরং প্রতীক হয়ে উঠেছে এক নবযুগের সূচনার।