শবেবরাতে করণীয় ও বর্জনীয়

শবেবরাত এক মহিমান্বিত রজনী। এর অর্থ ভাগ্যরজনী বা মুক্তির রজনী। বিপুলসংখ্যক মানুষকে আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা করে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন বলে এ রাতকে মুক্তির রজনী বলা হয়। কারো কারো মতে এ রাতে মানুষের ভাগ্য নির্ধারিত হয়, এজন্য তাকে ভাগ্যরজনী বলা হয়। অর্থ কিংবা নামকরণের কারণ যাই হোক, এ রাতের বিশেষ একটা ফজিলত যে আছে তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। এজন্য এ রাতটি একান্ত ব্যক্তিগত ইবাদতে কাটানো উচিত।করণীয়: শবেবরাতের ফজিলতের কথা হাদিস শরিফে বর্ণিত হলেও এ রাতের নির্দিষ্ট কোনো আমলের কথা বর্ণিত হয়নি। এজন্য এ রজনীতে সম্মিলিত ইবাদতে লিপ্ত হওয়ার চেয়ে একাকী ইবাদত-বন্দেগি করা উত্তম। মহানবী (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম এ রাতে নির্জনেই ইবাদত করতেন।

ক্ষমাপ্রার্থনা: এ রাতে মুশরিক এবং বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করে দেওয়া হয় মর্মে হাদিস শরিফে ঘোষণা এসেছে। হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা অর্ধ শাবানের রাতে (শবেবরাতে) সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করে দেন।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস: ৫৬৬৫) অন্য হাদিসে হজরত আলি (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যখন অর্ধ শাবানের রাত আসে, তোমরা এ রাতে ইবাদত করো এবং দিনে রোজা রাখো। এ রাতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তায়ালা প্রথম আসমানে আসেন এবং ঘোষণা করেন, আছে কি কোনো ক্ষমাপ্রার্থী? আমি তাকে ক্ষমা করব। আছে কি কোনো জীবিকা অন্বেষী? আমি তাকে জীবিকা দেবো। আছে কি কোনো বিপদগ্রস্ত? আমি তাকে বিপদ থেকে রক্ষা করব। এভাবে সকাল পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা মানুষের প্রয়োজনের কথা বলে বলে ডাকতে থাকেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১৩৮৮) সুতরাং আমাদের উচিত, বিশেষ এ রাতে আল্লাহ তায়ালার কাছে তওবা, ক্ষমাপ্রার্থনা, কান্নাকাটি ও দোয়ার মাধ্যমে নিজেদের পাপ-মোচন করানো এবং আল্লাহর রহমত প্রত্যাশী হওয়া।
কবর জিয়ারত: কবর জিয়ারত একটি গুরুত্বপূর্ণ নেকির কাজ। এটি জীবিতদের ওপর মৃত ব্যক্তির অধিকারও। এর দ্বারা মানুষের হৃদয়মন নরম-কোমল এবং আখেরাতমুখী হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) উম্মতকে এ কাজের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। হজরত বুরাইদা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে তিনি বলেন, ‘আমি কবর জিয়ারত করা থেকে তোমাদের নিষেধ করেছিলাম। মুহাম্মদকে তাঁর মায়ের কবর জিয়ারত করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সুতরাং তোমরা কবর জিয়ারত করতে পারো, কেননা তা আখেরাতের কথা স্মরণ করায়।’ (জামে তিরমিজি, হাদিস: ১০৫৪)।

শবেবরাতে তাই কবর জিয়ারত করে কবরবাসীর জন্য আল্লাহর দরবারে ক্ষমাপ্রার্থনা করা উচিত। মহানবী (সা.) এ রাতে কবর জিয়ারত করেছেন মর্মেও হাদিস পাওয়া যায়। হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, ‘কোনো এক রাতে আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে (বিছানায় আমার পাশে) না পেয়ে বের হলাম এবং (খুঁজতে খুঁজতে) জান্নাতুল বাকিতে গিয়ে তাঁকে পেলাম। তিনি বললেন, তোমার কি এই আশঙ্কা হয়েছে যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল তোমার হক বিনষ্ট করবেন? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমার ধারণা হয়েছে যে, আপনি হয়ত অন্য কোনো স্ত্রীর নিকট গমন করেছেন। মহানবী (সা.) তখন বললেন, অর্ধ শাবানের রাতে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার আসমানে আসেন এবং কালব গোত্রের বকরির পশমের চেয়ে বেশি গোনাহ মাফ করে দেন।’ (জামে তিরমিজি, হাদিস: ৭৩৯) এ দুটি আমলের পাশাপাশি তসবিহ, জিকির, কোরআন তেলাওয়াত, দিনের বেলা রোজা পালনসহ ব্যক্তিগত যেকোনো ইবাদত এ রাতে করা উত্তম।

বর্জনীয়: শবেবরাত ইবাদত পালনের রাত। এ রাতে তাই ইবাদত ভিন্ন অন্যকিছু করা যাবে না। কিন্তু আমরা না-বুঝে কিংবা শয়তানের ধোঁকায় পড়ে শবেবরাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাতে অহেতুক কাজকর্মে লিপ্ত হয়ে যাই। যেমন মসজিদ, ঘরবাড়ি, দোকানপাট আলোকসজ্জা করা, পটকা ফোটানো, আতশবাজি করা, খিচুড়ি, হালুয়ারুটি কিংবা মিষ্টি বিতরণ করা, অযথা কবরস্থান কিংবা মাজারে ভিড় করা, মহিলাদের বেপর্দা হয়ে মাঠেঘাটে মার্কেটে ঘুরে বেড়ানো প্রভৃতি। এসবগুলোই শরিয়ত নিষিদ্ধ গর্হিত ও পাপকাজ। এগুলো থেকে সম্পূর্ণরূপে বেঁচে থাকা একান্ত কর্তব্য। গোসল: শবেবরাতের আগমনে কেউ কেউ সন্ধ্যার পর গোসল করে থাকে এবং এটাকে বিশেষ আমল এবং নেকির কাজ মনে করে। এ রাতের এমন কোনো আমলের কোরআন-হাদিসের কোথাও বর্ণিত হয়নি। তাই এটা থেকেও বেঁচে থাকা উচিত।

আল্লাহ তায়ালা আমাদের বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি থেকে মুক্ত থেকে শবেবরাতে অধিক পরিমাণে শরিয়ত অনুমোদিত আমল করার তওফিক দান করুন। আমিন।