জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন, জন্ম বা মৃত্যু নিবন্ধন, ওয়ারিশ সনদ কিংবা ট্রেড লাইসেন্স নাগরিক জীবনের এই সাধারণ সেবাগুলোই হয়ে ওঠে অসাধারণ জটিল, যখন এর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে দুর্নীতি ও দালালচক্রের অদৃশ্য জাল।রাইজিংবিডি.কম
গত ১৩ মে রাজধানীর নগর ভবনের এমন এক অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন বংশালের সাহেলা বেগম। তিনি বলেন, “মেয়ের জন্ম নিবন্ধনের বানান ভুল ছিল। তিনবার এসে ফিরে গেছি। শেষে দালালের মাধ্যমে দুই হাজার টাকা দিয়ে কাজ করেছি। তবেই কাজ হয়েছে।”
এ অভিজ্ঞতা শুধু সালেহার একার নয়। রাজধানীসহ সারা দেশের নাগরিকদের জন্য এ যেন এক নিরব চিত্র। তবে এবার সেই চিত্র পাল্টাতে চায় সরকার। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় গ্রহণ করেছে সমন্বিত ডিজিটাল সেবা প্ল্যাটফর্ম চালুর উদ্যোগ, যা নাগরিকদের কাছে সরকারি সেবা পৌঁছে দিতে পারে সরাসরি ও স্বচ্ছ পদ্ধতিতে।
এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, “আমরা এমন একটি প্ল্যাটফর্ম গড়তে চাই, যেখানে নাগরিক ঘরে বসেই আবেদন করতে পারবে, অগ্রগতি দেখতে পারবে, আর সেবা না পেলে সহজেই অভিযোগ জানাতে পারবে।”
তিনি বলেন,“ঘুষ নয়, থাকবে ডিজিটাল ট্রেইল। দালালের জায়গা নেবে তথ্যের স্বচ্ছতা।”
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে যেসব সেবা
প্রথম ধাপে যেসব সেবা ধাপে ধাপে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হচ্ছে, তা হলো জন্ম, মৃত্যু ও বিবাহ নিবন্ধন, নাগরিক ও ওয়ারিশ সনদ, ট্রেড লাইসেন্স প্রদান ও নবায়ন, হোল্ডিং ট্যাক্স পরিশোধ, গ্রাম আদালতের নথি ও শুনানি, অভিযোগ গ্রহণ ও ট্র্যাকিং সিস্টেম।
প্রতিটি সিটি করপোরেশন, পৌরসভার প্রতিটি ওয়ার্ডে, ইউনিয়ন পরিষদে গড়ে তোলা হবে একটি করে ‘ডিজিটাল সেবা ডেস্ক’। যেখানে থাকবেন প্রশিক্ষিত আইটি কর্মকর্তা। এছাড়া নাগরিকরা চাইলে মোবাইল অ্যাপ, ওয়েবসাইট বা ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমেও আবেদন করতে পারবেন।
এ বিষয়ে তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্লেষক শাওন মাহমুদ বলেন, “ডিজিটাল রূপান্তর মানে শুধু একটি সফটওয়্যার নয়, এটি মানসিকতার পরিবর্তন। মাঠ পর্যায়ের লোকবলকে প্রশিক্ষিত করতে হবে, জনগণকেও প্রযুক্তি ব্যবহারে উৎসাহী ও সক্ষম করে তুলতে হবে।”
এ বিষয়ে সাবেক সচিব ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. ফরিদুজ্জামান বলেন, “ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম মানে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা। আগে যেটা অদৃশ্য ছিল, এখন তা দৃশ্যমান হবে। ফলে দুর্নীতির পথ সংকুচিত হবে।”
মাঠপর্যায়ের চিত্র
তবে বাস্তবতার মাটিতে দাঁড়িয়ে এখনো কিছু বাঁধা রয়ে গেছে। অনেক ইউনিয়ন পরিষদে নেই ভালো ইন্টারনেট সংযোগ, নেই প্রশিক্ষিত জনবল বা আধুনিক অবকাঠামো।
সাভারের একজন ইউপি চেয়ারম্যান (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, “ডিজিটাল হইলে মানুষ সরাসরি কাজ করতে পারবে। আমাদের কাছে আর আসবে না। এতে এলাকায় ভাবমূর্তি থাকলেও, লোকজন আর আমাদের সম্মান দিবে না।”
এই মনোভাবকেই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।কারণ প্রথাগত ক্ষমতা ও দৃষ্টিভঙ্গিই এখন বড় অন্তরায়। তবে আশার আলোও আছে। ডিজিটাল সিস্টেম চালু হওয়ার পর কাজ সহজ হয়েছে এমনটি জানিয়েছেন ঝালকাঠির সদর উপজেলার গাভা রামচন্দ্রপুর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান জাকির হোসেন লিটন।
তিনি বলেন, “প্রথমে ভয় পেয়েছিলাম, ডিজিটাল হলে জনপ্রতিনিধির গুরুত্ব কমে যাবে। কিন্তু এখন বুঝি, এটি বরং আমাদের কাজকে সহজ করেছে। মানুষ সরাসরি আবেদন করলে আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারি। এতে জনগণের আস্থা যেমন বাড়ে, তেমনি স্বচ্ছতাও নিশ্চিত হয়।”
গাভা ইউনিয়ন পরিষদের তিন নম্বর ওয়ার্ড মেম্বার রুহুল আমিন বলেন, “ডিজিটাল সিস্টেম চালু হওয়ার পর আমাদের কাজ সহজ হয়েছে। জনগণও খুশি, কারণ তারা এখন সরাসরি দেখতে পারে তাদের আবেদনের অবস্থা কোথায় আছে।”
পরিকল্পনা
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীন স্থানীয় সরকার বিভাগ ইতোমধ্যে রূপান্তর প্রক্রিয়া। এর মধ্যে রয়েছে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার (ইউডিসি)-এর সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে। এলজিডি ড্যাশবোর্ড চালু হচ্ছে, যেখানে প্রতিটি প্রকল্প, বরাদ্দ ও অগ্রগতি দেখা যাবে। নাগরিকদের জন্য চালু হচ্ছে ওয়ান-স্টপ ডিজিটাল সার্ভিস পোর্টাল, যেখানে ঘরে বসেই মিলবে সনদ, আবেদন ও অভিযোগ জানানো সুযোগ।”
প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদের জন্য ডিজিটাল প্রকল্প ট্র্যাকিং সিস্টেম চালু হবে, যেখানে স্থানীয় জনগণও দেখতে পারবে কোন প্রকল্পে কত টাকা বরাদ্দ হলো এবং তার অগ্রগতি কোথায়।
২০২৬ সালের মধ্যে দেশব্যাপী উদ্যোগ নেওয়া হবে। বর্তমানে পরীক্ষামূলকভাবে চালু রয়েছে দেশের ২০০টি ইউনিয়নে।মন্ত্রণালয়ের লক্ষ্য ২০২৬ সালের মধ্যে দেশের ৪৫৭১টি ইউনিয়নেই ডিজিটাল সেবা চালুর পরিকল্পনা করা হয়েছে।
উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব বলেন, “আমরা এমন এক বাংলাদেশ গড়তে চাই, যেখানে সেবা পেতে কারও মুখ চিনতে হবে না। একজন নাগরিক হিসেবে অধিকার থাকলেই যথেষ্ট হবে।”
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) কর্মকর্তা মো. জাহিদ হাসান বলেন, “জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তবে আন্তরিকভাবে বাস্তবায়ন হলে, এটি শুধু স্থানীয় সরকার নয়, গোটা প্রশাসনিক সংস্কৃতির রূপান্তরের উদাহরণ হয়ে উঠবে।”