আলোচিত সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্তে কাজ করছে টাস্কফোর্স। তারা সাংবাদিক নেতা, ওই সময় দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে। একই সঙ্গে হত্যার রহস্যভেদে তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তাসহ পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করছে। তবে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এখনই আশাবাদী হতে চায় না সাগর-রুনির পরিবারের সদস্যরা।২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি মাছরাঙা টেলিভিশনের তৎকালীন বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার এবং এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনিকে হত্যা করা হয়। ওই সময় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অপরাধীদের গ্রেপ্তারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেই ৪৮ ঘণ্টা পার হয়ে আজ ১৩ বছর পূর্ণ হয়েছে, তবু আঁধারেই ডুবে আছে সেই হত্যারহস্য। আলোর মুখ দেখেনি তদন্ত।কে বা কারা এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত, জানা যায়নি আজও।
এমন পরিস্থিতিতে কাজ করছে টাস্কফোর্স। আজ মঙ্গলবার এই হত্যাকাণ্ডের ১৩ বছর পূর্ণ হলো। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর সাগর ও রুনি হত্যার ঘটনায় করা মামলার তদন্তে বিভিন্ন বাহিনীর অভিজ্ঞ তদন্ত কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টাস্কফোর্স গঠনের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।তাদের ছয় মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে মামলার মূল তদন্ত থেকে র্যাবকে সরিয়ে দেওয়ারও আদেশ দেওয়া হয়।
রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের শুনানি নিয়ে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি মুহাম্মদ মাহবুব উল ইসলামের হাইকোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দেন। এ বিষয়ে পরবর্তী আদেশের জন্য আগামী ৬ এপ্রিল তারিখ ধার্য করা হয়।
হাইকোর্টের নির্দেশে গত ১৭ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে একটি টাস্কফোর্স গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।এতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) প্রধানকে আহ্বায়ক করে চার সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের টাস্কফোর্স কমিটি গঠন করা হয়েছে। এতে অতিরিক্ত ডিআইজি পদমর্যাদার নিচে নয়—পুলিশের এমন একজন প্রতিনিধি, সিআইডির একজন প্রতিনিধি এবং র্যাবের একজন প্রতিনিধিকে রাখা হয়।
এর আগে ৩০ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপক্ষকে সহযোগিতা করতে শিশির মনিরসহ ৯ আইনজীবী নিয়োগের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেন মামলার বাদী নওশের আলম। গত ১ অক্টোবর ঢাকার অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মাহবুবুল হকের আদালত শুনানি শেষে এ আবেদনটি মঞ্জুর করেন। সর্বশেষ গত ২৭ জানুয়ারি এ মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য ছিল। তবে ওই দিন তদন্ত প্রতিবেদন জমা না হওয়ায় আগামী ২ মার্চ পরবর্তী দিন ধার্য করা হয়। এতে এ মামলাটি তদন্তে ১১৫ বার সময় নেওয়া হয়েছে।
এ মামলার আসামিরা হলেন রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মাসুম মিন্টু, কামরুল ইসলাম ওরফে অরুণ, আবু সাঈদ, সাগর-রুনির বাড়ির দুই নিরাপত্তারক্ষী পলাশ রুদ্র পাল ও এনায়েত আহমেদ এবং তাঁদের ‘বন্ধু’ তানভীর রহমান খান। এঁদের মধ্যে তানভীর ও পলাশ জামিনে আছেন। অন্যরা কারাগারে আটক রয়েছেন।
মামলার সূত্রে জানা গেছে, এই খুনের ঘটনায় নিহত রুনির ভাই নওশের আলম রোমান শেরেবাংলানগর থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। প্রথমে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন ওই থানার এক উপপরিদর্শক (এসআই)। চার দিন পর চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলার তদন্তভার ডিবির কাছে হস্তান্তর করা হয়। দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে তদন্ত করে রহস্য উদঘাটনে ব্যর্থ হয় ডিবি। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে একই বছরের ১৮ এপ্রিল হত্যা মামলাটির তদন্তভার র্যাবের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তবে এক যুগের বেশি সময় তদন্ত করলেও র্যাব দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখাতে পারেনি।
নিহত রুনির ভাই ও মামলার বাদী নওশের আলম রোমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তদন্ত নিয়ে সরকার আশাবাদী। টাস্কফোর্স গঠন হয়েছে, তারা তদন্ত করছে৷ তাদের নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। আমরা তো তদন্তের সব কিছু দেখতে পাচ্ছি না। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এখনই আশাবাদী হতে পারছি না।’
সাংবাদিক সাগর সরওয়ারের মা সালেহা মনির বলেন, ‘র্যাব তো পারে নাই। এখন দেখা যাক পিবিআই কী করে। তারা তো অনেক জটিল মামলার রহস্য উদঘাটন করেছে। আমি তদন্ত নিয়ে আশাবাদী। যদি রাঘব বোয়ালদের বাদ দিয়ে চোর-ডাকাতকে অভিযুক্ত করা হয়, তাহলে তো মানব না। ভাবব পিবিআই মূল আসামিদের পাশ কাটিয়ে তদন্ত করেছে।’
মামলার বিষয়ে পিবিআইয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আজিজুল হক বলেন, ‘হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী মামলার তদন্ত কার্যক্রম চলছে। তবে এখনই তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে কিছু বলা যাবে না। তদন্ত সাপেক্ষে আমরা যথাসময়ে প্রতিবেদন দাখিল করব।’
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের অন্যতম ব্যর্থতা এই হত্যা মামলার তদন্ত শেষ করতে না পারা। এই মামলার রহস্য উদঘাটনে টাস্কফোর্স কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত শেষে আদালতে অভিযোগপত্র এলে আমরা দ্রুত বিচার কার্যক্রম শেষ করতে কাজ করব।’
গত ৮ ফেব্রুয়ারি সাগর-রুনি হিউম্যান রাইটস ফটো অ্যাওয়ার্ড ২০২৫-এর আলোকচিত্র প্রদর্শনী শেষে বাদীপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, ‘আগামী ৪ এপ্রিল হাইকোর্ট বিভাগে টাস্কফোর্স কমিটির প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা। টাস্কফোর্সের সঙ্গে আমাদের মিটিং হয়েছে। এখন আমার কাছে মনে হয়, খুব অল্প সময়ের মধ্যে এই রহস্য উন্মোচন হবে।’